একটি যুদ্ধের ফলে শুধু একটি পরিবার বা একজন ব্যক্তি নিঃস্ব হয় না, সেইসঙ্গে পঙ্গু হয় একটি দেশও। আর তাই যুগে যুগে যুদ্ধবাজরা আক্রান্ত দেশের কৃতী সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীল নকশাও আঁকে। উদ্দেশ্য সেই জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। ১৯৭১-এ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারাও সেই উদ্দেশ্যেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার এ চক্রান্তে যুক্ত হয়েছিল তাদেরই হাতে তৈরি আলবদর, আলশামস বাহিনী। মূলত এ বাহিনীই তৈরি করে দেয় বুদ্ধিজীবী নিধনের তালিকা।
আজ সেই ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির শোকের দিন। স্বজন হারানোর বেদনাবিধুর দিন। বাঙালির জাতীয় জীবনে একাধারে শোক ও শক্তির প্রতীক এই দিনটি। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের শেষলগ্নে বাঙালি যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী দোসররা মেতে ওঠে দেশের বুদ্ধিজীবীদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞে। বিজয়ের চূড়ান্ত মুহূর্তে বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ দেশের মেধাবী সন্তানদের পরিকল্পিতভাবে সেই নৃশংস নিধনযজ্ঞ গোটা বিশ্বকেই হতবিহ্বল করে তোলে।
তবে বিচ্ছিন্নভাবে এ হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে। আর তালিকা ধরে খুঁজে খুঁজে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় ১৯৭১-এর সেপ্টেম্বরে। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় আসার আগমুহূর্ত পর্যন্ত এদেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা চলতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের তারিখ নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর নীলনকশা অনুযায়ী বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীকে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর, স্বাধীনতার অব্যবহিত আগে বাড়ি থেকে তুলে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী এবং প্রকৌশলী-শিল্পী-সাহিত্যিক মিলে ১ হাজার ১১৯ জনের সন্ধান মেলে। তবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মোট কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো অজানা।
এত বড় ক্ষতি এবং শোকের ভার বহনের ক্ষমতা ছিল না বাঙালির। সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করে বাঙালি জাতির শোককে শক্তিতে পরিণত করেন। তবে আক্ষেপের বিষয় হলো, আমরা স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় সে অর্থে বুদ্ধিজীবী নিধনের এখনো বিচার সম্পন্ন করতে পারিনি এবং বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা কেউ কেউ আজো দেশের বাইরে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী নিধনের সঙ্গে অনেকেই জড়িত থাকতে পারে; কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, সে সময় এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত কমিটি করা হলেও সে কমিটির রিপোর্ট আজো আলোর মুখ দেখেনি। ওই কমিটির অন্তর্ভুক্ত অনেক সদস্যই আজ পরলোকগত। যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এখনো হচ্ছে; ঠিক সেভাবেই জাতির সূর্যসন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার দেশবাসী কামনা করে। এই হত্যাকাণ্ডের একটি গবেষণামূলক সরেজমিন তদন্ত হওয়া উচিত। আমাদের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বাইরেও শুধু দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরিয়ে দেওয়া ও হত্যার সঙ্গে যুক্ত অনেক নাম বেরিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। এখনো অনেকে বিদেশে পলায়নরত। তাদেরকে ফিরিয়ে এনে শাস্তির আওতায় আনা আবশ্যক। বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার পক্ষের বর্তমান সরকার এ বিষয়টিতে নজর দেবেন।
একাত্তরে আত্মত্যাগকারী দেশের বুদ্ধিজীবীরা বাহ্যিক অস্তিত্বে হারিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু বাঙালির মানসলোকে চির জাগরূক থাকবে তাদের মহৎ দর্শন। এসব বুদ্ধিজীবীর আদর্শ ও চিন্তা অনুকরণীয় হবে নবপ্রজন্মের কাছে। আমাদের চেতনায় প্রবাহিত হোক তাদের মহত্তম জীবনদর্শন, আমরা এই প্রত্যাশাই করি।