বাংলা ভাষা নিয়ে যে কয়েকজন প্রতিথযশা কাজ করেছেন তার মধ্যে অসিতকুমার বন্দ্যোপ্যাধায় একজন। তিনি একাধারে গবেষণা, অধ্যাপনা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।এই প্রতিথযশা ব্যাক্তিকে নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক–
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালের ৩ জুন উত্তর চব্বিশ পরগনার বনগাঁতে। তাঁর পিতা ছিলেন অক্ষয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা চারুবালা দেবী। ১৯২৫ সাল থেকেই তারা হাওড়ায় বসবাস করতে থাকেন। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় আমৃত্যু হাওড়াতেই থেকেছেন।
১৯৩৮ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক পরীক্ষায় পাস করেন। বাংলায় তার পাওয়া ৭৭% নম্বর ছিল তখনকার সময়ে জেলার মধ্যে এই বিষয়ে সর্বোচ্চ। এরপর তৎকালীন রিপন কলেজ, বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে তিনি আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই পরীক্ষায় বাংলা ও আসাম-এর পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক স্তরে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলেজে পড়ার সময়েই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সায়গন থেকে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলো তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন এবং সেগুলো ফরোয়ার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ব্রিটিশ শাসন ও যুদ্ধপরিস্থিতির নিরিখে এ ছিল এক দুঃসাহসিক দেশপ্রেমের পরিচয়।
১৯৪৫ সালে নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধ্যাপনা জীবনের শুরু। এরপর তিনি রিপন কলেজে পড়াতে আসেন। ১৯৫৭ সালে যোগদান করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় চেয়ার অধ্যাপকের পদে ব্রত হন। ১৯৮৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অবসর নেন। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পরে ২০০২ সালে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি হয়েছিলেন।তিঁনি আমৃত্যু এই পদে সমাসীন ছিলেন।
লেখক
দশ খণ্ডের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’র মতো এই রকম মহা পরিকল্পনা নিয়ে একক প্রয়াসে এত বড় মাপের গবেষণা এর আগে বাংলা সাহিত্যে হয়নি। দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখার কাজটা শুরু করেছিলেন দু-খণ্ডে প্রকাশিত বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বইতে। সুকুমার সেন এর পাঁচ-খণ্ডে লেখা বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস এ আচার্য অনেক বেশি মৌলিক কথা বলেছেন। কিন্তু বিভিন্ন মতের মধ্যেকার বিতর্ক, নানা দৃষ্টিকোণের তুলনামূলক আলোচনা, সাম্প্রতিকতম গবেষণা অবধি সমস্ত তথ্যের সমন্বয় এবং অবশ্যই তার সঙ্গে নিজের গবেষণা, বিশ্লেষণ ও অভিমত যেভাবে অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পাওয়া যায়, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায় – এমন কাজ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে এর আগে বা পরে আর হয়নি।
অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসামান্য গবেষণা কর্মের সবচেয়ে মৌলিক অংশটি পাওয়া যাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পর্ব থেকে ঊনিশ শতকের প্রথম পর্ব — ভারতচন্দ্রের পর থেকে মাইকেলের আগে অবধি বাংলা সাহিত্যের তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত পর্বটি নিয়ে। মহা গ্রন্থের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ খণ্ডে প্রায় আড়াই হাজার পাতায় যে তথ্য বিশ্লেষণ ও সাহিত্য বিচারের নিদর্শন তিনি হাজির করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তার তুলনা কমই আছে।
এই প্রতিথযশা অধ্যাপক, লেখক ও গবেষকের ২০০৩ সালের ২১ শে মার্চ জীবনাবসান ঘটে।
তিনি আমাদের জন্য মূল্যবান গবেষণাকর্ম রেখে গিয়েছেন। যে ঋণ শোধ করা যাবেনা।তাঁর মৃত্যুদিবসে শ্রদ্ধাসহকারে স্মরণ করছি। তার সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে সবসময় তিনি স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের কাছে।
লেখিকা: হামিদা আব্বাসী
শিক্ষার্থী, বিবিএ,শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া
ও ইন্টারনেট