করোনাভাইরাস মহামারির কারণে গত এক বছর ধরে গোটা বিশ্ব নাজুক অবস্থায় পড়েছে। এর সংক্রমণের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে জনসমাগম এড়িয়ে চলাতেই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম। তারপর থেকেই বিশ্বের সকল একে অপরের সাথে সব ধরনের যোগাযোগ সীমিত করেছে।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চে মাসের ৮ তারিখ প্রথম করোনা ধরা পড়ে। ওই মাসের ১৮ তারিখ থেকে দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। অন্যান্য কার্যক্রমের সাথে ২০২০ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রাখার পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়নি পাবলিক পরীক্ষাগুলো। ধীরে ধীরে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পেলে সরকার শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে টেলিভিশনে পাঠদানের পরিকল্পনা করে এবং দেশের সরকারি চ্যানেলে ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দও দেয়। কিন্তু বিকল্প এ শিক্ষাদানের চেষ্টায় সাফল্য এসেছে কমই। আর এসব কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা এখনো যেমন চূড়ান্ত হয়নি, তেমনই কবে স্কুল-কলেজ খুলবে তাও এখনো নির্ধারণ করতে পারেনি সরকার। এইচএসসি ও সমমানের প্রায় বারো লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় তাদের ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। পরীক্ষার জন্য তারা যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাতে ছেদ পড়েছে। পরীক্ষা কবে হবে সেই অনিশ্চয়তা তাদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও প্রায় ১২ লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা ও ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক চেষ্টায় সেশনজট কমিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে আবারও বড় রকমের সেশনজটে পড়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি।
এছাড়াও স্কুলে অনেক বাচ্চার সঙ্গে মেশা ও শেখা-এক আলাদা তৃপ্তি, আলাদা সামাজিকীকরণ। এখন বাসায় পড়ানোর চেষ্টা করলেও দেখা যায় বাচ্চাদের আগ্রহ নেই। পরীক্ষা হচ্ছে না অনেকদিন ধরে। পরীক্ষা কীভাবে হয় সেটাও অনেকের মনে নেই। পড়ার আগ্রহ অনেকটাই কমে গেছে। পরিবর্তে স্মার্টফোন, টেলিভিশন ইত্যাদির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ছেলেমেয়েরা। এতে আচরণের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তন আসছে। অনেকে পড়াশোনার ব্যাপার মাথা থেকে বের করে দিয়ে অনলাইনের বিভিন্ন ধরনের কাজ শুরু করেছে। এভাবে চলতে থাকলে ছেলেমেয়েদের মধ্যে থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিষয়টা উঠে যাবে। ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে একযোগে পড়ার মাধ্যমে যে শিক্ষণ প্রক্রিয়া, সেটি না থাকায় এ বছরে যা যা শেখা উচিত তার অনেকখানিই হয়নি।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের তাই অনলাইন শিক্ষায় যুক্ত করা হয়েছে কিন্তু সবাই এর সুফল পাচ্ছে না। আর এটি একমুখী শিক্ষাদান। সেখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। তার উল্লেখযোগ্য কারণ হলো দেশ প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে। এছাড়াও অনেক শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত হওয়ায় উচ্চ মূল্যের স্মার্টফোন বা টেলিভিশন কিনে ক্লাস করা প্রায় অসম্ভব। সিপিডি’র এক তথ্যানুযায়ী, করোনার আগে এ দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার কারণে ৭০ শতাংশ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় দারিদ্র্যের হার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এমতাবস্থায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার জন্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। অনেকের স্বাভাবিক চিন্তাশীলতা লোপ পাচ্ছে। ফলে তারা বিভিন্ন আত্মঘাতী সীধান্ত নিচ্ছে। আইইডিসিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত একবছরে বাংলাদেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৪ হাজার। এই সংখ্যা আগের বছরগুলোর চেয়ে বেশি। সুনির্দিষ্টভাবে কোভিড নিয়ে কুসংস্কার, সংক্রমণের আতঙ্ক, মৃত্যুভয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, বেকারত্বের মতো কারণে বাড়ছে মানসিক সংকট।
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। মানসিক চাপ কমাতে হবে। এ জন্য ঘুমানোর স্বাভাবিক সময় ঠিক রাখতে হবে, নিজের পছন্দের বিষয় ও কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে, পরিবারের সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে। সেই সাথে পরস্পরকে উৎসাহ দেওয়া, পরস্পরের কাজে সহযোগিতা করা, ঘরের মধ্যেই একসঙ্গে সময় কাটানো ও পছন্দের কাজ ইত্যাদি প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
এছাড়া প্রতিদিন কিছু সময় অবশ্যই শরীর চর্চা করা, নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী ঘরেই প্রার্থনা করা ও সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের করতে হবে। এতে মানসিক প্রশান্তি মিলে। এছাড়া অবিভাবকদের পরিবারের শিশুদের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। ঘরের মধ্যেই তাদের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। সুস্থ মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাদের সমস্যা শুনে তা সমাধান করতে হবে। অবসর সময়ে বই পড়ে মানসিক অবসাদ, বিষন্নতা, একাকিত্ম ইত্যাদি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। জাতির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আসতে দেওয়া যেতে পারে।
লেখক: শাকিবুল হাসান
সদস্য, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।
কুশিয়ারাভিউ২৪ডটকম/২৯ জু, ২০২১/শাকিবুল