আজ ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের এই দিনে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। বিজয় উৎসবে ফেটে পড়েন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সেই সাথে পাকসেনারা দল বেঁধে অস্ত্র উপরে উঠিয়ে তাদের পরাজয়ের দৃশ্য অবতরণ করে সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।
মুক্তিযুদ্ধের দাবানলের সূচনালগ্নে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক তৎকালীন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মরহুম আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে নেতৃবৃন্দ ফেঞ্চুগঞ্জ থানা থেকে অস্ত্র নিয়ে ফেঞ্চুগঞ্জের শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে পাহারা বসানো হয়।
ফেঞ্চুগঞ্জের কৃতি সাহসী যোদ্ধা মরহুম সৈয়দ মকবুল আলী, শহীদ ডা. ফয়েজ মিয়া, সাবেক ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়া, আনসার কমান্ডার আজমল হোসেন রইফসহ কয়েকজন পাহারায় অংশ নেয়। এরই মধ্যে কয়েকজন সাহসী যোদ্ধা পাক সেনারা ফেঞ্চুগঞ্জ আগমনে প্রতিবন্ধকতা হিসাবে ফেঞ্চুগঞ্জ ইলাশপুর রেলওয়ে ব্রীজ ডিনামাইট বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে দল বেঁধে ফেঞ্চুগঞ্জ এলাকা প্রবেশ করে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের ‘কাইয়ার গুদামে’ আস্তানা গড়ে। এরই সঙ্গে দালালদের সহায়তায় মেতে ওঠে হত্যাযজ্ঞে।
শুরুতেই রাজাকারদের সহায়তায় ফেঞ্চুগঞ্জ ইসলামপুর গ্রামের তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম হাজী আছকর আলীর বাড়িতে হানা দেয়। এ সময় তাকে না পেয়ে নতুন ও পুরাতন দুটি বাড়িতে গান পাউডার ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
হানাদার বাহিনীর হাতে আছকরের বড় ছেলে ফেঞ্চুগঞ্জ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আসাদুজ্জামান বাচ্চু প্রথম শহীদ হন।
হানাদাররা ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানা অতিথি ভবন ও মনিপুর চা-বাগানের ঘাঁটিতে চালাতো নারী নির্যাতন। ফেঞ্চুগঞ্জ পশ্চিম বাজারে বিশাল কাইয়ার গুদাম পরিণত হয় হায়েনাদের বন্দিশালায়। সেখানে ধরে এনে রাখা হতো ফেঞ্চুগঞ্জ সহ পাশ্ববর্তী উপজেলার মুক্তিকামী লোকজনসহ যুবতী মেয়েদের। যুবতী মেয়েদের উপর চলতো দিনের পর দিন পাশবিক নির্যাতন।
কত বাঙালির বুকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে কাইয়ার গুদাম তা আজও অজানা।
প্রতি রাতে বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি করে শহীদ করা হতো। এরপর কুশিয়ারার বুকে লাশ ভাসিয়ে দিতো হায়নারা। ফেঞ্চুগঞ্জ মুক্ত হবার পর কাইয়ার গুদামে শত শত জনতার ভিড় জমে এবং স্বজন হারাদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।
ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে পালিয়ে যাবার আগে বর্বর হানাদাররা কুশিয়ারার দক্ষিণ পাড়ে ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার ও রাজনপুর এলাকায় বিশাল গাড়ির বহর পুড়িয়ে দেয়। অন্যান্য যুদ্ধ সামগ্রী ও বিনষ্ট করে। অনেক খন্ড যুদ্ধের পর ১০ ডিসেম্বর বড় ধরনের সম্মুখ যুদ্ধ শুরু হয়। কুশিয়ারা নদীর উত্তর পাড়ে পাক হানাদাররা অবস্থান নেয়। দক্ষিণ পাড় থেকে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী কুশিয়ারার রেল সেতুর ওপর দিয়ে উত্তর পাড়ের দিকে অগ্রসর হয়। তখন অতর্কিত আক্রমণ করে পাক সেনারা। সেতুর ওপর সারিবদ্ধ মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা মুহুর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন কুশিয়ারা নদীর বুকে। এ যুদ্ধে কতজন মুক্তিসেনা ও মিত্রসেনা শহীদ হয়েছেন তা জানা যায় নি।
উত্তর পাড়ের ধান ক্ষেতে ও ব্যাংকারে মিলেছিলো পাকসেনাদের অসংখ্য মরদেহ মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর লড়াইয়ে বিপর্যস্ত পাক হানাদাররা পরদিন ফেঞ্চুগঞ্জের মাটি ছেড়ে সিলেটের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর মধ্য দিয়ে শত্রু মুক্ত হয়েছিল ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা। এরপর মুক্তিকামী মানুষ লাল সবুজের পতাকা নিয়ে জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত করেছিলো ফেঞ্চুগঞ্জের আকাশ-বাতাস।